মোঃ নিজাম উদ্দিন, চকরিয়া:
নিরব প্রকৃতির প্রতিবন্ধী নারীর নাম নুরুন নাহার। আধুনিকতার কোন ছোঁয়া তার কাছে পৌঁছেনি। মিঠাপান বিখ্যাত মহেশখালীর হোয়ানক নামক ইউনিয়নের আয়েশা খাতুনের গর্ভে তার জন্ম। পিতা বৃদ্ধা ছৈয়দ আহমদ সন্তান নির্ভর হওয়ায় বেঁচে থেকেও যেন জ্যান্ত পাথর। কন্যার দুঃখে মুছবার চোখের জল ফেলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা ছাড়া তার কোন সামর্থ নেই। পারিবারিক পরিবেশ ও সংসারের অস্বচ্ছলতায় নুরুন নাহার শিক্ষার আলো থেকে ছিল বঞ্চিত। ছোটকালে দূর্ঘটনায় পায়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে এখনো প্রায় প্রতিবন্ধি। ভাইদের স্ত্রীর উপর বোঝা এই নুরুন নাহার পেটের খোরক দিতে অবশেষে চট্টগ্রাম শহরে পাড়ি দেয়।
গত তিন বছর ধরে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের চাকরি করে কোনমতে প্রাণ বাঁচে নুরুন নাহার। এদিকে অভাবের বুঝা টানতে গিয়ে কখন যে যৌবন পার হয়ে যাচ্ছে নারীর খেয়ালই নেই। হয়ে গেল ত্রিশ কাচাকাছি বয়স আর চেহারায় পড়লো বয়সের ছাপ। চলন্ত পথিক ক্লান্ত যখন হঠাৎ একদিন পেয়ে গেল জলের আবাস। জল নাকি মরিচিকা ভেবে দেখার সময় ছিল না তার।
সে আর কেউ নয় চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ পাড়া গ্রামের ইসলাম আহমদের পুত্র চৌত্রিশ বয়সী শফিউল আলম। তার কু মনোভাব বুঝতে পারেনি সরল মনা নুরুন নাহার। বিয়ে করবে পূর্ণ আশ্বাসে দুজন একসাথে বসবাস করে দুই মাসের অধিক সময়।
গত ১৮ নভেম্বর চকরিয়াতে ভাড়া বাসা নিয়ে বিয়ে করে একসাথে থাকবে আশ্বাসে তারা চকরিয়া পৌর শহরে আসে। এতে হঠাৎ দেখা হয় নুরুন নাহারের সম্পর্কের দুলাভাই রহমত উল্লাহর সাথে। তাকে সব খুলে বলায় রহমত উল্লাহর রহমত পড়ে তাদের উপর। বিয়ের দিকে এগোতে প্রেমিক শফিউল আলমসহ তারা উভয় রহমত উল্লাহর বসতবাড়ি ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড রিংভং চলে আসে। পরদিন শফিউল আলমের স্বজনদের খোঁজ নিতে গিয়ে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো নুরুন নাহার ও দুলাভাই রহমত উল্লাহর। জানতে পারে শফিউলের সংসারে রয়েছে স্ত্রী-সন্তানরা। আর তাদের সংসারে বড় ছেলে ডুলাহাজারা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। থলের বিড়াল বেরিয়ে আসায় অর্থাৎ প্রকৃত সত্য বেরিয়ে হলে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়রা প্রেমিক শফিউল আলমকে আটক করে। ওইদিন বিকেলে উভয় পক্ষের ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে দুলাভাই রহমত উল্লাহর বসতবাড়ি রিংভং-এ সালিসে বসে।
বৈঠকে প্রতারক শফিউলের পক্ষে তার স্বজন সাবেক এক ইউপি সদস্য ও ডুলাহাজারা ৪নং ওয়ার্ডের জয়নাল আবেদীন সোনামিয়া মেম্বার উপস্থিত ছিলেন। প্রেমের সম্পর্ক জড়ানোর পূর্বে প্রেমিকের বিস্তারিত খবরা-খবর না নেওয়াটাই নুরুন নাহারের ভুল ছিল বলে উল্লেখ করেন সালিসকাররা। এসময় বিয়ে করতে উভয় রাজী থাকলেও সংসারের স্থায়িত্ব সন্দেহজনক মনে করে বিবাহ বিষয়ক সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি তারা। অবশেষে বিচারের রায়ে প্রেমিক শফিউল আলম প্রতারণার অপরাধে প্রেমিকা নুরুন নাহারকে ২০হাজার নগদ টাকা প্রদান করে ঘটনা নিস্পত্তির ঘোষণা দেন ইউপি সদস্য রফিক।
রায় শুনে প্রেমিকা নুরুন নাহার বুক ফাটা আর্তনাদ চাপিয়ে রাখতে পারেনি। আর উপায় না দেখে বিচারক মেম্বারের রায়কে সম্মান প্রদর্শণে সুপারিশ করেন তার স্বজনরা। শেষপর্যন্ত এই দুখিনী নারী তার ভালবাসাকে সমহিত করে মনের দুঃখকে পাথর চাপা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বৈঠকে স্টাম্পে পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে ২০হাজার টাকা বুঝিয়ে দেবে মর্মে দায়ীত্ব নেন আসামী পক্ষের ডুলাহাজারা ইউপি মেম্বার সোনামিয়া।
কিন্তু ওই টাকা এক সপ্তাহ পরও দেখা মেলেনি। পরে নুরুন নাহারের অভিভাবকরা ডুলাহাজারা চেয়ারম্যানকে নুরুল আমিন ও বিচারক ইউপি সদস্য রফিককে অবগত করেন। কিন্তু তারা ওই ২০টাকা আদায়ে ব্যর্থ জানিয়ে আইনের আশ্রয় নিতে বলেন।
কিন্তু টাকাগুলো উদ্বারে উপরস্থ বিচারক প্রান্তে যেতে চাইলে পারিপার্শ্বিক কারণে নুরুন নাহারের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরিদিন প্রেমের দাফন কাফনের সেই ২০ হাজার টাকাও না পেয়ে শুণ্য হাতে ফিরে যেতে হলো এই সর্বহারা নারীর।
সঙ্গত কারনে নারী ও তার মাতাপিতার নাম ভিন্নতর প্রকাশ করা হলো